জীবনে কোনদিন মুখের ঘা হয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মুখের ভেতরে, দাঁতের
মাড়িতে এবং জিভে ছোট ছোট ঘা দেখা যায় অনেক সময় যা বেশ কষ্টদায়ক ও
অস্বস্তিকর। দেহের কোনো বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীন অঙ্গে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত যা
স্বাভাবিক নিয়মে সেরে ওঠে না,তাদের আলসার বলা হয়। মুখের এই ধরনের ঘা কে বলা
হয় অ্যাপথাস আলসার বা ক্যাংকার সোর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ১-২
সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এক দুই মাসও স্থায়ী
হতে পারে। মুখের ঘায়ের সমস্যাকে আমরা খুবই সাধারণভাবে দেখে থাকি। তবে এই
বিষয়কে অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
এখন জেনে নেওয়া যাক মুখের ঘা কেন হয়? মুখের ঘা প্রধানত নিম্নলিখিত কারণে হয়ে
থাকেঃ
ভিটামিন বি-১(থায়ামিন), বি-২(রিবোফ্লাভিন), ফলিক এসিড, বি-১২(কোবালামিন) ইত্যাদির অভাবজনিত কারণে
জিংক ও আয়রনের অভাব
ফুড অ্যালার্জি
অতিরিক্ত মসলা জাতীয় খাবার গ্রহণ
অতিরিক্ত চকোলেট, কফি, স্ট্রবেরি, অম্লীয় ফল যেমনঃ লেবু, আনারস, কমলা,টমেটো ইত্যাদি গ্রহণ
অতিরিক্ত পান, সুপারি, জর্দা থেকে মুখের ভেতরে চামড়া উঠে, মাড়ি ও মুখের নরম মাংসপেশী ক্ষয় হয়েও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অ্যালকোহল সেবন
ধূমপান
পাকস্থলীর ক্ষত(পেপটিক আলসার) সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া হেলিকোব্যাক্টর
পিলোরি-র কারণে
খুব গরম খাবার বা পানীয় খেতে গিয়ে ছাল উঠে গেলে
শক্ত ব্রাশের খোঁচা লাগা
দাঁতের চিকিৎসার সময় হালকা আঘাত পেলে
মুখের অভ্যন্তরে কোন ধারালো দাঁতের কারণে কেটে ছিঁড়ে গেলে
দাঁতে অতিরিক্ত পাথর থাকলেও মুখে ঘা হতে পারে
টুথপেস্টে বিদ্যমান এসএলএস বা সোডিয়াম লরিল সালফেট যা কোন কোন ক্ষেত্রে মুখে ঘা সৃষ্টি করতে পারে
জিহ্বায় ছত্রাকের সংক্রমণ
আবেগজনিত মানসিক চাপ
তবে অনেক ক্ষেত্রে মুখের ঘা কিছু বড় সমস্যার যেমনঃ সিলিয়াক ডিজিজ, ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ, ডায়াবেটিস, এইচঅাইভি/ এইডস ইত্যাদির ইঙ্গিত বহন করে ।
মুখের আলসার নিরাময়ঃ
রিবোফ্লাভিন এন্টিঅক্সিডেণ্ট হিসেবে কাজ করে। রিবোফ্লাভিন বা ভিটামিন বি২ দেহের জন্য ক্ষতিকর অংশের সাথে যুদ্ধ করে যা ফ্রি র্যাডিকেলস নামে পরিচিত। এর অভাবে ঠোঁট ফাটা বা মুখ ও জিহ্বার আবরণে প্রদাহ দেখা দেয়। এছাড়াও মুখের কোণায় ঘা যা চিলোসিস নামে পরিচিত।
বয়স অনু্যায়ী রিভোফ্লাবিনের দৈনিক চাহিদার ক্ষেত্রে কিছুটা তারতম্য দেখা যায়। যেমনঃ
০-৬ মাস বয়সী শিশুর জন্য দৈনিক ০.৩মিলি.গ্রা
৫-১২মাস বয়সী শিশুর জন্য দৈনিক ০.৪মিলি.গ্রা
১-৩ বছরের শিশুর জন্য দৈনিক ০.৫মিলি.গ্রা
৩-৮ বছরের শিশুর জন্য দৈনিক ০.৯মিলি.গ্রা
৮-১৩ বছরের জন্য দৈনিক ০.৯মিলি.গ্রা
১৩-১৮ বছরের জন্য দৈনিক ১.৩মিলি.গ্রা(ছেলেদের)এবং ১মিলি.গ্রা (মেয়েদের)
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য দৈনিক ১.৪মিলি.গ্রা
দুগ্ধদানকারী মহিলাদের জন্য দৈনিক ১.৬মিলি.গ্রা দুধ, দই, মাংস, কলিজা, ডিম, মাশরুম, রিভোফ্লাভিনের ভাল উৎস।
ফলিক এসিড বা ভিটামিন বি৯ এর অভাবে মুখে আলসার এবং জিহ্বায় ফোলাভাব দেখা দেয়।
কতটুকু ফলিক এসিড আমাদের দৈনিক গ্রহণ করা উচিত??
বয়স/গ্রুপ | মাত্রা |
গর্ভবতী মহিলা | ৬০০মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
প্রসূতি মাতা | ৬০০মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
০-৬মাস বয়সী শিশু | ৬৫মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
৭-১২মাস বয়সী শিশু | ৮০মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
১-৩ বছর | ১৫০মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
৪-৮বছর | ২০০মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
৯-১৩বছর | ৩০০মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
১৪-১৮বছর | ৪০০মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
১৯+ বছর | ৪০০মাইক্রো.গ্রা/প্রতিদিন |
বীচি ও ডাল জাতীয় খাবার, ডিম, সবুজ শাক, কলিজা, বাদাম ইত্যাদি ফলিক এসিডের ভালো উৎস।
- ভিটামিন সি ক্ষতস্থান শুকাতে সাহায্য করে। দাঁত, হাড় ও কার্টিলেজের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি এর অভাবে মাড়ি খুবই নরম হয়ে যেতে পারে এবং রক্তপাত হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ভিটামিন সি গ্রহণ করা উচিত। ভিটামিন সি এর দৈনিক প্রয়োজন বিভিন্ন দেশ ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর নিজস্ব মান অনুযায়ী সামান্য তারতম্য দেখা যায়।
বয়স/গ্রুপ | মাত্রা |
গর্ভবতী মহিলা | ৮৫মিলি.গ্রা/প্রতিদিন |
প্রসূতি মাতা | ১২০মিলি.গ্রা/প্রতিদিন |
০-৬মাস বয়সী শিশু | ৪০মিলি.গ্রা/প্রতিদিন |
৭-১২মাস বয়সী শিশু | ৫০মিলি.গ্রা/প্রতিদিন |
১-৩ বছর | ১৫মিলি.গ্রা/প্রতিদিন |
৪-৮বছর | ২৫মিলি.গ্রা/প্রতিদিন |
৯-১৩বছর | ৪৫মিলি.গ্রা/প্রতিদিন |
১৪-১৮বছর | ৭৫.গ্রা/প্রতিদিন(ছেলেদের)
৬৫.গ্রা/প্রতিদিন(মেয়েদের) |
১৯+ বছর | ৯০.গ্রা/প্রতিদিন(ছেলেদের)
৭৫.গ্রা/প্রতিদিন(মেয়েদের) |
আমলকি, পেয়ারা, লেবু, টমেটো, কাঁচামরিচ, আনারস, সবুজ শাকসবজি, ব্রকলি, ফুলকপিতে ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
- ভিটামিনের পাশাপাশি মিনারেলসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মুখের আলসার নিরাময়ে। জিংকের অভাবে মুখে বারবার অ্যাপথাস আলসার হতে পারে। পুরুষের দৈনিক ১১মিলিগ্রাম এবং নারীর ৮মিলিগ্রাম জিংকের চাহিদা রয়েছে। হাড়ের সাথে লেগে থাকা মাংস, মাশরুম, পালং শাক, ব্রকলি,বিভিন্ন বাদাম ও বীজ, দুধ, টকদই, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় রাখলে নিমিষেই পূরণ হবে জিংকের ঘাটতি।
মুখের ঘা নিরাময়ে ঘরোয়া টোটকাঃ
- গরম পানিতে লবণ অথবা বেকিং সোডা ব্যবহার করে কুলকুচি করা ।
- নরম তন্তুর ব্রাশ ব্যবহার করা
- অম্লীয় ফল যেমন কমলা, আনারস,লেবু,টমেটো,আপেল ইত্যাদি ঘা অবস্থায় এড়িয়ে চলতে হবে।
- অতিরিক্ত তেল মশলা দেয়া খাবার খেলে ঘায়ে জ্বালা হয়,তাই তেল মশলা কম ব্যাবহার করতে হবে।
- সিগারেট, পান,জর্দা , সুপারি পরিত্যাগ করতে হব।
যে লক্ষণ গুলো দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেনঃ
- ঘা অস্বাভাবিক বড় আকারের হলে
- ৩ সপ্তাহের বেশি সময়েও ভালো না হলে
- পুরোনো ঘা ভালো না হতেই পুনরায় ঘা হলে
- ব্যাথাহীন ঘা হলে
- ঘা ঠোঁট পর্যন্ত বিস্তৃত হলে
- ঘা এর সাথে জ্বর বা ডায়রিয়া হলে
লেখক- বিজয়া সাহা
সম্পাদক- হুমায়রা নাজনীন
866 total views, 2 views today
Any opinion ..?